| |
               

মূল পাতা আন্তর্জাতিক পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েত নির্বাচনকে ঘিরে এত সহিংসতা কেনো?


পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েত নির্বাচনকে ঘিরে এত সহিংসতা কেনো?


আন্তর্জাতিক ডেস্ক     27 June, 2023     10:01 PM    


পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত নির্বাচনকে ঘিরে চলমান সহিংসতায় মঙ্গলবার সকালে আরো এক রাজনৈতিক কর্মীর মৃত্যু হয়েছে বলে পুলিশ জানিয়েছে। ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেস দলের এক মন্ত্রী অভিযোগ করেছেন যে উত্তরাঞ্চলীয় কোচবিচার জেলার ওই ঘটনায় দুষ্কৃতিদের বাংলাদেশ থেকে নিয়ে আসা হয়েছিল। কোচবিহার জেলার পুলিশ বলছে মঙ্গলবার ভোরে দিনহাটা থানা এলাকার জারিধরলা এলাকায় দুই দলের সমর্থকদের মধ্যে গোলাগুলি শুরু হয়। অন্তত পাঁচজন গুলিবিদ্ধ হন। এদের মধ্যে বাবলু হক নামে এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে বলে পুলিশ জানিয়েছে। স্থানীয় সূত্রগুলি জানাচ্ছে, জারিধরলা এলাকাটি একেবারেই বাংলাদেশ সীমান্তে এবং সেখানে একমাত্র নৌকা করেই যাওয়া যায়।

তৃণমূল কংগ্রেস দাবী করছে যে নিহত ব্যক্তি তাদের দলের কর্মী। গুলি চালনার জন্য দুষ্কৃতিদের বাংলাদেশ থেকে নিয়ে আসা হয়েছিল বলে অভিযোগ করছেন উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী এবং দিনহাটা শহরেরই বাসিন্দা উদয়ন গুহ। তার কথায়, “কেউ তো আর ওপর থেকে এসে গুলি চালায় নি, ওপার থেকে এসে গুলি করেছে। বিজেপির কয়েকজন নেতা বিভিন্ন রাজ্য এবং প্রতিবেশী রাষ্ট্র থেকে সমাজবিরোধী আর গুণ্ডাদের নিয়ে এসে এখানে অশান্তি সৃষ্টি করার চেষ্টা করছে। যেখানে ওই ঘটনা হয়েছে, সেটা একেবারেই সীমান্তের জিরো পয়েন্ট। কোনও কাঁটাতারের বেড়া নেই, একদিকে নদী, সেখানে বাইরে থেকে লোক এসে অতর্কিতে গুলি চালিয়ে একজনকে হত্যা করেছে।“

বিজেপি স্বাভাবিকভাবেই এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে। দলটির অন্যতম মুখপাত্র দীপ্তিমান সেনগুপ্তর কথায়, “এর আগেও তো গুলি চলেছে, দিনহাটা শহরেই হয়েছে তা। সেগুলোও কি বাংলাদেশ থেকে লোক এসে ঘটিয়েছিল? শহরের মানুষ তো দেখেছেন কারা গুলি চালিয়েছিল! সামাজিক মাধ্যমে তো সেইসব ভিডিও আছে। ঘটনা ওরাই ঘটাচ্ছে, দোষ দেওয়া হচ্ছে বিজেপিকে।“

এখনও অবধি ১১ জন নিহত
পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত নির্বাচন সবসময়েই সহিংস হয়। সব থেকে বেশি মৃত্যু হয়েছিল ২০০৩ সালের ভোটে। সেবার ৮০ জন মারা গিয়েছিলেন। এবার মঙ্গলবারের ঘটনা নিয়ে পঞ্চায়েত নির্বাচন ঘোষণা হওয়ার পরে গত ১৯ দিনে ১১ জনের মৃত্যু হল। নিহতদের মধ্যে তৃণমূল কংগ্রেস, কংগ্রেস, সিপিএম, বিজেপি এবং ফুরফুরা শরিফের পীরজাদা আব্বাস সিদ্দিকির নেতৃত্বাধীন ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্ট বা আইএসএফ কর্মীরাও আছেন। রাজ্যে ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত নির্বাচন হবে আট জুলাই। গুলি এবং বোমায় নিহত হওয়ার ঘটনা ছাড়াও আহত হয়েছেন আরও অনেকে। প্রায় প্রতিদিনই নির্বাচনী সহিংসতার খবর পাওয়া যাচ্ছে রাজ্যের বিভিন্ন এলাকা থেকে। সহিংসতা রুখতে কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশে ৮২২ কোম্পানি কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন করছে রাজ্য নির্বাচন কমিশন। একেকটি কোম্পানিতে গড়ে ৭৫ থেকে ৮০ জন নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য থাকেন। যে সংখ্যক বাহিনী মোতায়েন এসেছে, তাদের যেমন শুরু হয়ে গেছে কিন্তু এখনও পর্যন্ত মাত্র অর্ধেকের কিছু বেশি বাহিনী এসে পৌঁছিয়েছে। মঙ্গলবারের ঘটনায় যিনি মারা গেছেন, তিনি তো তৃণমূল কংগ্রেসের কর্মী। নিজের দলের কর্মীকেই কেন মারবে তৃণমূল কংগ্রেস? এই প্রশ্নের জবাবে বিজেপির মুখপাত্র দীপ্তিমান সেনগুপ্ত বলছিলেন, “পঞ্চায়েত ভোটের আগে তৃণমূল কংগ্রেসে গোষ্ঠী দ্বন্দ্বের জেরেই নিজের দলের লোককেই মারছে আরেক গোষ্ঠী। বহু জায়গাতেই তৃণমূল কংগ্রেসের একাধিক প্রার্থী মনোনয়ন জমা দিয়েছে, তারই ফলশ্রুতি এটা।“

প্রায় ৭২ হাজার আসনে ভোট
পঞ্চায়েত নির্বাচনের তিনটি স্তর রয়েছে। প্রথম স্তরে আছে গ্রাম পঞ্চায়েত। একেকটি উন্নয়ন ব্লকের পঞ্চায়েতগুলির ওপরে দ্বিতীয় স্তরে আছে পঞ্চায়েত সমিতি। আর জেলা স্তরে এই স্থানীয় সরকারের কাজ করে জেলা পরিষদ। এবারের ভোটে গ্রাম পঞ্চায়েত আসন ৬২ হাজার ৪০৪ টি, পঞ্চায়েত সমিতির আসন নয় হাজার ৪৯৮ টি এবং জেলা পরিষদের আসন ৯২৮ টি। এই গ্রাম পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতি আর জেলা পরিষদের মাধ্যমেই উন্নয়নমূলক প্রকল্পগুলির জন্য বরাদ্দ খরচ করা হয়। এর জন্য বিভিন্ন কেন্দ্রীয় প্রকল্প থেকে যেমন অর্থ আসে, তেমনই রাজ্য সরকারও অর্থ বরাদ্দ করে পঞ্চায়েতগুলিকে।

ভারতে প্রতি পাঁচ বছর ধরে অর্থ কমিশন তৈরি হয় এবং এখন কাজ করছে পঞ্চদশ অর্থ কমিশন। শুধুমাত্র অর্থ কমিশনই পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েতগুলির মাধ্যমে গ্রামীণ পরিকাঠামো উন্নয়নে প্রকল্পগুলিতে খরচের জন্য ২০২২-২৩ আর্থিক বছরে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করেছিল। অর্থ কমিশনের বরাদ্দ টাকা ছাড়াও ব্যক্তিগত আবাস তৈরি, টয়লেট বানানো, রাস্তা তৈরি, পুকুর খোঁড়া ইত্যাদির মতো প্রকল্পেও অর্থ আসে কেন্দ্র সরকারের কাছ থেকে। তৃণমূল কংগ্রেস বারেবারেই অভিযোগ করে যে কেন্দ্রীয় সরকার তাদের পাওনা অর্থ আটকিয়ে রেখেছে।

বিপুল অর্থের হাতছানি, তাই ভোটে জিততে মরিয়া
মমতা ব্যানার্জী অর্থ বরাদ্দ আটকিয়ে রাখার অভিযোগ করলেও যে বিপুল পরিমাণ অর্থ আসে, তার অঙ্কটাও বিশাল। “এইসব উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থের ভাগ পাওয়ার লোভেই পঞ্চায়েত ভোটে জিততে মরিয়া হয়ে ওঠেন প্রার্থীরা, সেজন্যই এত সহিংসতা হয় এই নির্বাচনে। নাহলে, একজন পঞ্চায়েত সদস্যর মাসিক বেতন হাজার তিনেক টাকা, এই সামান্য টাকা বেতনের কাজের জন্য কেউ এতটা মরিয়া হয়ে ওঠে?” বলছিলেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক বিশ্বজিত ভট্টাচার্য। তার কথায়, “১৯৭৮ সালে যখন থেকে পশ্চিমবঙ্গে ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত ব্যবস্থা চালু হয়েছে, তখন থেকেই বিভিন্ন প্রকল্পে বিপুল অঙ্কের অর্থ আসতে শুরু করে। একেকটা প্রকল্পের জন্য কয়েকশো কোটি টাকাও আসে, এবং প্রকল্পের সংখ্যাও অনেক। বরাদ্দকৃত এই বিপুল অর্থে যে দুর্নীতি হচ্ছে, সেটা প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন দেখিয়েছিলেন রাজীব গান্ধী। তিনি হিসাব দিয়ে বলেছিলেন কেন্দ্র একটা প্রকল্পে যত অর্থ বরাদ্দ করে, তার ৮০ শতাংশ আর শেষ মানুষটি পর্যন্ত পৌঁছয়ই না।“

বিশ্লেষক আর রাজনীতিবিদরা বলছেন, পঞ্চায়েত স্তরে দুর্নীতি বামফ্রন্ট আমল থেকেই হয়ে আসছে। তাই সেই সময়েও পঞ্চায়েত নির্বাচনে জেতার জন্য হিংসার আশ্রয় নিত দলগুলি।

“পঞ্চায়েতের দুর্নীতিতে প্রতিটা রাজনৈতিক দলের নেতা কর্মীরাই জড়িত আছেন, কেউ কম কেউ বেশি,” বলছিলেন এক নেতা। তিনি নিজের পরিচয় এবং দলীয় পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে বলছিলেন, “কোনও দল বলতে পারবে না যে তাদের পঞ্চায়েত সদস্যরা দুর্নীতি করেন না। তৃণমূল, বিজেপি, কংগ্রেস, বামফ্রন্ট – প্রতিটা দলই এতে জড়িত, কেউ কম কেউ বেশি।“

ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেসও স্বীকার করছে যে পঞ্চায়েত সদস্যের একটা অংশ দুর্নীতি করার জন্যই ভোটে জিততে গিয়ে সহিংস পথ নিচ্ছেন।

“এটা আংশিক সত্য, তবে পুরোটা নয়,” বলছিলেন তৃণমূল কংগ্রেসের সংসদ সদস্য সুখেন্দু শেখর রায়। তার কথায়, “পঞ্চায়েত স্তরের দুর্নীতিটা চালু হয়েছিল বামফ্রন্টের আমল থেকেই। তখনই পঞ্চায়েতকে ঘিরে দুর্নীতি একটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে এখনও অনেক পঞ্চায়েত সদস্যই দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত। তবে আমরা একেবারে গ্রামস্তর থেকে রিপোর্ট নিয়ে এবারে প্রার্থী ঠিক করেছি। যাদের বিরুদ্ধে স্থানীয় মানুষ দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছেন, তাদের কিন্তু আমরা টিকিট দিই নি এবার।“

কিভাবে পঞ্চায়েতে দুর্নীতি হয়?
যে রাজনৈতিক নেতা নাম প্রকাশ করতে চাইলেন না, তার কথায়, “গ্রামাঞ্চলে এখন সবথেকে বড় দুর্নীতির জায়গা হচ্ছে আবাস যোজনা। এই প্রকল্পে একেকটি পরিবার পাকা ঘর তৈরির জন্য এক লাখ ৬৭ হাজার টাকা করে পায়। এই অর্থ পাওয়ার জন্য পঞ্চায়েত সদস্যকে দিতে হয় ১০ শতাংশ অর্থ। এটাই চলতি রেট। এছাড়া বিদ্যুৎ সংযোগ নেওয়া, বাড়ির সামনে রাস্তা করিয়ে দেওয়া, ব্যাঙ্ক ঋণ পাইয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা – এসব থেকেও প্রচুর আয় করেন একেকজন পঞ্চায়েত সদস্য। পঞ্চায়েত সদস্যদের আরেকটা বড় রোজগারের পথ হল বিভিন্ন ধরনের সার্টিফিকেট প্রদান করা। হাজার হাজার মানুষ অন্য রাজ্যে কাজ করতে যান, তাদের রেসিডেন্ট সার্টিফিকেট প্রয়োজন হয়। সেটার জন্য টাকা নেয়া হয়।

“পঞ্চায়েত সদস্যদের সম্প্রতি আরেকটা বড় রোজগারের পথ হয়ে উঠেছে গ্রাম্য সালিশিগুলো,” বলছিলেন উত্তরবঙ্গের একটি জেলার এক গ্রামবাসী। তিনিও রাজনৈতিক দলগুলির কোপে পড়ার আশঙ্কায় নিজের নাম এবং গ্রামের নাম প্রকাশ করতে দিতে চাইলেন না। তিনি বলছিলেন, আবাস যোজনা, রাস্তা, বিদ্যুৎ, সার্টিফিকেট দেওয়া, নানা প্রকল্পে আবেদন জমা দেওয়া এসবের জন্য টাকা নেওয়া তো ছিলই। কিন্তু এখন পারিবারিক ঝামেলাতেও সালিশি করতে চলে আসেন পঞ্চায়েত সদস্যরা। আর সেখানে বিচারের একমাত্র মাপকাঠি হল যে পক্ষ বেশি অর্থ দিতে পারবে, রায় তার পক্ষেই যাবে। আবার সাধারণ মানুষও দুর্নীতিতে যুক্ত থাকে অনেক সময়ে। মহাত্মা গান্ধী গ্রামীণ রোজগার প্রকল্প, যে প্রকল্প‘১০০ দিনের কাজ’ হিসাবেই পরিচিত, সেখানে রাস্তা বা পুকুর না কেটেই তার জন্য বরাদ্দ অর্থ তুলে নেওয়া হয়। সেক্ষেত্রে গ্রামের যে বাসিন্দা টাকা পাচ্ছেন, তার আর পঞ্চায়েত সদস্যর মধ্যে আধাআধি ভাগ হয় টাকাটা।

পাঁচ বছরে ৫০ লক্ষ
নাম প্রকাশ না করার শর্তে যে রাজনৈতিক নেতা বিবিসির সঙ্গে কথা বলেছেন, তিনি জানাচ্ছিলেন, “একেক জন গ্রাম পঞ্চায়েত সদস্য তার পাঁচ বছরের মেয়াদে অন্তত ৫০ লক্ষ টাকা দুর্নীতির মাধ্যমে রোজগার করেন, এবং এটা শুধুমাত্র সরকারী প্রকল্পগুলির অর্থ গ্রামের মানুষকে পাইয়ে দেওয়ার বিনিময়ে। এর বাইরে তো রাস্তা তৈরি বা অন্যান্য কাজের বরাদ্দ যারা পান, সেইসব ঠিকাদারদের কাছ থেকেও টাকা তোলেন পঞ্চায়েত সদস্যরা। অথচ তাদের সরকারী বেতন মাত্র হাজার তিনেক টাকা, তো এই বিপুল অর্থের হাতছানি যেখানে, সেখানে সহিংসতার আশ্রয় তো নেবেই।“

আবার পঞ্চায়েত সদস্যদের নিজস্ব বাহিনীও থাকে। “এরা ভোটের সময়ে তাদের ‘দাদা’র হয়ে কাজ করে আর বছরভর নানা সিণ্ডিকেট ব্যবসা ইত্যাদির সঙ্গে জড়িত থাকে। কংগ্রেস আমল বা বামফ্রন্ট আমলেও এই বাহিনী ছিল। তাদের কখনও বাস-মিনিবাসে কর্মসংস্থানের সুযোগ করে রোজগারের পথ করে দেওয়া হয়েছিল, কখনও রিকশা-অটোরিকশার পারমিট করিয়ে দিয়ে আয়ের পথ করে দেওয়া হয়েছে, আর এখন নির্মাণ সিণ্ডিকেটের মতো আইন বহির্ভূত, সমান্তরাল অর্থনৈতিক কাজে ব্যবহার করা হয়। বিনিময়ে ভোটের সময়ে সহিংসতা বা সন্ত্রাস করানো হয় এই লুম্পেন বাহিনীকে দিয়েই,” বলছিলেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক বিশ্বজিত ভট্টাচার্য।

সূত্র : বিবিসি বাংলা