রহমত নিউজ 18 September, 2025 11:44 AM
সম্প্রতি আল্লামা জুনায়েদ বাবুনুগরী (রহ.) -এর জীবন কর্ম ও অবদান শীর্ষক আলোচনা সভায় দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদরাসার শিক্ষক ও হেফাজতের অন্যতম নেতা মাওলানা আশরাফ আলী নিজামপুরী বলেছেন, “হাটহাজারীর হেফাজত হাটহাজারীতেই নিরাপদ। হেফাজতে কোনো দালালের জায়গা হবে না।”
তার এই বক্তব্য ঘিরে সোশ্যাল মিডিয়ায় তৈরি হয় আলোচনা-সমালোচনার ঝড়।
গতকাল বুধবার (১৭ সেপ্টেম্বর) এক ফেসবুক পোস্টে তিনি বিষয়টির ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তার সেই পোস্ট পাঠকদের জন্য হুবহু তুলে ধরা হলো।
ফেসবুক পোস্টে তিনি যা লিখেছেন হুবহু :
সম্প্রতি ক্বায়েদে মিল্লাত আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরীর স্মরণ সভায় দেওয়া—আমার বক্তব্যকে বিভিন্নজন বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করছেন। সুতরাং এ বক্তব্যের মূল ম্যাসেজ পরিষ্কার করা জরুরি মনে করছি। ‘হাটহাজারীর হেফাজত হাটহাজারীতেই নিরাপদ’ এ বাক্যের প্রথম অংশ— ‘হাটহাজারীর হেফাজত’ বলতে আমরা সকলেই অবগত আছি, হেফাজত সৃষ্টি হয়েছে হাটহাজারী থেকে, ২০০৯ ঈ. সনে হেফাজত উম্মুল মাদারিস নামক মায়ের গর্ভে ছিল। ২০১০ ঈ. সনে হেফাজতের জন্ম হয়। জন্মের পর তিন বছর ২০১৩ ঈ. সন পর্যন্ত হেফাজত হাটহাজারী বা চট্টগ্রামে লালিত-পালিত হয়।
২০১৩ ঈ.সনে শাপলা ট্র্যাজেডির পর হেফাজত চট্টগ্রামের বাইরে বিভিন্ন জেলায় এমনকি পুরো বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। হেফাজত যে হাটহাজারীরই সৃষ্টি এ কথা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই—এ হলো হাটহাজারীর হেফাজতের ব্যাখ্যা।
তারপর ‘হাটহাজারীতেই নিরাপদ’ এ বাক্যের ব্যাখ্যা অনেক বড়। একজন মন্তব্য করলেন– হাটহাজারীর দেয়ালের ভেতরে কীভাবে নিরাপদ থাকবে হেফাজত! আরেকজন বললেন–হাটহাজারী নয়, হেফাজত বাংলাদেশেই নিরাপদ, হায়রে পণ্ডিত!
মূল কথা হলো— হাটহাজারী সৃষ্টি করেছে বিধায় হাটহাজারী মাদরাসা থেকেই হেফাজতের আমীর-মহাসচিব নিযুক্ত হওয়া জরুরি নয়। তবে নিয়ন্ত্রণ; চেইন অফ কমান্ড, জবাবদিহিতা হাটহাজারীতেই থাকা নিরাপদ। কারণ বর্তমানে আমার জানা মতে হাটহাজারী মাদরাসার সকল আসাতিযায়ে কিরাম অরাজনৈতিক এবং আমানতদার। তাছাড়া শায়খুল ইসলাম আল্লামা আহমদ শফী এবং ক্বায়েদে মিল্লাত আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী রাহ.-এর সত্যায়িত ও দস্তখতকৃত হেফাজতের গঠনতন্ত্রে পরিষ্কার ভাষায় স্ট্রেইট ফরওয়ার্ড লেখা রয়েছে—“হেফাজতের সদর দপ্তর হবে দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদরাসা এবং হাটহাজারী মাদরাসার মুরুব্বিদের পরামর্শে হেফাজত পরিচালিত হবে” সুতরাং হেফাজতের মূল চালিকাশক্তি হাটহাজারী মাদরাসার মুরুব্বিদের হাতেই থাকবে এটাই চূড়ান্ত কথা। অরাজনৈতিক হেফাজত অরাজনৈতিক ব্যক্তিদের নিকটই নিরাপদ, রাজনৈতিকদের হাতে নিরাপদ নয়। হেফাজত মহাসচিবের সম্মান ড.ইউনূস থেকেও বেশি।
হেফাজতের মহাসচিব আল্লামা সাজিদুর রহমান হাফি. জামাতে কুদূরী থেকে হাটহাজারী মাদরাসায় লেখাপড়া করেছেন এবং ১৯৮৩-৮৪ ঈ. সনে হাটহাজারী মাদরাসা থেকে ফারেগ হয়েছেন। ফারেগ হওয়ার দুই/তিন বছর পর হাটহাজারী মাদরাসায় শিক্ষক হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে তিনি হাটহাজারী মাদরাসায় শিক্ষকতা করেছিলেন। যেহেতু তিনি হাটহাজারী মাদরাসার চিন্তাধারা অন্তরে লালন করেন এবং তিনি একজন অরাজনৈতিক ব্যক্তি মূলত এ কারণেই আল্লামা নূরুল ইসলাম জিহাদীর ইন্তেকালের পর তাকে হেফাজতের মহাসচিব নিযুক্ত করা হয়। তাঁর সাথে ছাত্র জীবন থেকে এই পর্যন্ত আমার সুসম্পর্ক রয়েছে। সিলেট, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, বি-বাড়িয়া এসব জেলায় মাহফিলে গেলে অন্তত আমার রাতযাপন, খাওয়া-দাওয়া ইত্যাদি আল্লামা সাজিদুর রহমানের প্রতিষ্ঠিত জামিয়া দারে আরকামেই হয়।
.তিনি মহাসচিবের দায়িত্ব নেওয়ার পর একাধিকবার একান্তে হেফাজতের বিভিন্ন সমস্যার কথা তাঁকে বলা হয়েছে। এসব বিষয়ে সবসময় আল্লামা সাজিদুর রহমানের কথা একটাই—“তারা তো ভাই রাতে-দিনে কাজ করছেন, সময় দিচ্ছেন। আপনাদের আমাদের হাতে তো এতো বেশি সময় নেই। মাদরাসা এবং দরস-তাদরিস নিয়ে আমাদের সব সময় ব্যস্ত থাকতে হয়, এজন্য তাদের কিছু কিছু বিষয় অপছন্দ হলেও বাধ্য হয়ে আমাকে আঞ্জাম দিতে হয়।”
মূলত আমার বক্তব্যে হেফাজতের মহাসচিবকে নিয়ে কটাক্ষ করা নয় বরং হেফাজত ও হেফাজতের মহাসচিবকে বড় করে দেখাই আমার উদ্দেশ্য অর্থাৎ হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিব হয়েও হেফাজতের ব্যানারে ড. ইউনুসের আহ্বানে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় তিনি কেন যাবেন? যেখানে ড. ইউনুস রাজনৈতিক নেতাদের সাথে রাজনৈতিক বিষয় বা নির্বাচন নিয়ে কথা বলবেন! হেফাজতের ১৩ দফা নিয়ে একবার নয় পঞ্চাশ বার যমুনায় গেলেও কারো কোন আপত্তি থাকার কথা নয়। প্রশ্ন যমুনায় যাওয়া নিয়ে নয় বরং রাজনৈতিক দলের সাথে রাজনৈতিক আলাপে অংশগ্রহণ নিয়ে, কারণ হেফাজত তো অরাজনৈতিক।
ব্যক্তি-কেন্দ্রিক হেফাজত বিষয়ে অনেকেরই সাথে আমি কথা বলেছি এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় বারবার আলোচনা হয়েছে কারণ দলীয় ফোরামে আমার আলোচনা করার সুযোগ কই!? —বিগত দু’বছরে হেফাজতের কোনো মিটিংয়ে আমি/আমরা দাওয়াত পাইনি, যদিও আমি হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব। দাওয়াত না পাওয়ার কারণ হলো খাস কমিটি, আম কমিটি, আখাস্সুস খুসুস কমিটি, জরুরি কমিটি, ম্যানেজিং কমিটি—সব কমিটি চার-পাঁচ জন দিয়ে তৈরি। সুতরাং আমাদের অন্তরের কথা বলার জায়গা কই?
হাটহাজারী মাদরাসায় দাওরায়ে হাদীস শেষ করার পর দারুল উলূম দেওবন্দ যাওয়ার সময় যে কজন দেশের শীর্ষস্থানীয় আলেমদের সাথে আমি পরামর্শ করেছিলাম—শাইখুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক রাহ. তাদের একজন। ৩০ বছর আগে হযরত রাহ. এর দেওয়া অটোগ্রাফ এখনো আমার ডাইরিতে সংরক্ষিত আছে। শাইখুল হাদীসের পরিবারের প্রতি আমি সবসময় দুর্বল। মাওলানা মামুনুল হকের প্রতি ইতোপূর্বে হেফাজত বিষয়ে আমার কোনো অভিযোগ ছিল না, এখনো নেই। কারণ তার বড় ভাই মাওলানা মাহফুজ সাহেব আমার বন্ধু; দারুল উলুম দেওবন্দে আমরা একসাথে দাওরায়ে হাদীস পড়েছি। মাহফুজ ভাইয়ের সাথে বিভিন্ন বিষয়ে সবসময় আমার কথা হয়। কিছুদিন পূর্বে হেফাজত বিষয়েও কথা হয়েছে। তিনি আমাকে একদিন বলেছেন— “ঠিক আছে। আমি মামুনকে বলে দিব। আপনি এ বিষয়ে নিশ্চিত থাকেন।”
সুতরাং আমার বক্তব্যের সাথে মাওলানা মামুনুল হককে জড়িয়ে দেওয়া কোনোভাবেই কাম্য নয়। ক্বায়েদে মিল্লাত আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী রাহ. এর স্মরণ সভায় দেওয়া বক্তব্যের এটাই আমার মূল ম্যাসেজ। এবার আপনাদের যৌক্তিক ও গ্রহণযোগ্য মন্তব্য কামনা করছি।